বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে সমাজকর্ম শিক্ষা Social Work Education in Developed and Developing Country of the World

সমাজকর্ম একটি মহৎ পেশা যা ব্যক্তি, পরিবার, সম্প্রদায় এবং সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

সমাজের প্রান্তিক, দুর্বল এবং অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য সমাজকর্মীরা তাদের জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে থাকেন।

উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে সমাজকর্ম শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে।


বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে সমাজকর্ম শিক্ষা

সমাজকর্ম শিক্ষা

Social Work Education in Developed and Developing Country of the World


যুক্তরাজ্যের সমাজকর্ম শিক্ষা (Social Work Education in UK) 

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যখন যুক্তরাজ্যের হাসপাতালগুলোতে সমাজকর্মী নিয়োগ শুরু হয় তখন সমাজকর্মের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ঘটে। 

চিকিৎসা সমাজকর্মীদের ভূমিকা ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকে এবং তাদের প্রশিক্ষণের সুযোগ-সুবিধা বাড়তে থাকে। ১৯২০ সালে চিকিৎসা সমাজকর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য “Institute of Alomner's” প্রতিষ্ঠিত হয়। 

সাধারণ সমাজকর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য ১৯৭১ সালে “Central Council of Education and Training in Social Work (CCETSw)” প্রতিষ্ঠিত হয়। 

উল্লেখ করা হয়েছে যে, CCETSW সমাজকর্মীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করে থাকে। 

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের সমাজকর্ম শিক্ষাকেও CCETSW বৈধতা প্রদান করে থাকে। 

ব্রিটেনের সমাজকর্মীদের মৌলিক পেশাগত যোগ্যতা হচ্ছে সমাজকর্মে ডিপ্লোমা Diploma in Social Work: (DIPSW) পূর্বে ব্রিটেনের সমাজকর্মীগণ CQSW (Certificate of Qualification in Social Work) সার্টিফিকেট অর্জন করে স্থানীয় সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করত। 

আবার যারা আবাসিক কর্মী হিসেবে কাজ করত তাদের CSS (Certificate of Social Service) থাকলেই চলত। এখন সকল সমাজকর্মীরই DIPSW থাকতে হয়। 

তবে CCETSW সমাজকর্মীদের সময় উপযোগী প্রশিক্ষণ এবং জ্ঞান ও দক্ষতার উন্নয়নের দায়িত্ব পালন করে থাকে। 

১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ সরকার এক পর্যালোচনার মাধ্যমে CCETSW এবং “General Social Care Council (GSCC)" কে সমন্বিতভাবে সমাজকর্ম পেশার প্রশিক্ষণ এবং অনুশীলনের পেশাগত মান দেখাশুনার দায়িত্ব প্রদান করেছে। 

ব্রিটিশ সমাজকর্মী সংস্থা (British Association of Social Workers: BASW) সে দেশের সমাজকর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং পেশাগত উন্নয়নের দায়িত্ব পালন করে থাকে।

সমাজকর্ম শিক্ষার ফিল্ডওয়ার্ককে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। একজন সুদক্ষ সমাজকর্মীর তত্ত্বাবধানে ফিল্ডওয়ার্ক পরিচালিত হয়ে থাকে। 

পাঠ্যসূচির সাধারণ বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- পরিবার সমাজবিজ্ঞান, মানববর্ধন ও বিকাশ, পারিবারিক আইন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, মানববর্ধন ও বিকাশে ব্যক্তিত্ব বিকাশ, প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু মনস্তত্ত্ব, মানসিক অস্বাভাবিকতা ও শারীরিক স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে। 

১৯৮০ এর দশকে যুক্তরাজ্যের সমাজকর্ম শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার মান ও দক্ষ সমাজকর্মীদের পর্যালোচনার জন্য সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করে। 

যার ভিত্তিতে ১৯৯৪ সালে পেশাগত যোগ্যতা ও দক্ষতার দিগন্ত উন্মোচিত হয়। যাতে পূর্বের CQSW-এর পরিবর্তে ডিপ্লোমা ইন সোশ্যাল ওয়ার্ক (DIPSW) চালু হয়। 

এ সময় সমাজকর্মীদের জন্য তিনটি বিশেষ প্রোগ্রাম (Three post qualifying programmes) চালু করা হয়। সেখানকার সমাজকর্ম শিক্ষা নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০০১ সালে CCETSW-এর পরিবর্তে GSCC (General Social Care Council) গঠন করা হয়। 

২০০৪ সালে তিন বছরের বিএ ডিগ্রি এবং দুই বছরের এমএ ডিগ্রি চালু করা হয়। এছাড়া স্নাতক পরবর্তী সমাজকর্ম শিক্ষা এবং পিএডি-এর ব্যবস্থা আছে। 

আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে “Institute of Applied Social Sciences (IASS)” প্রতি বছর প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থীকে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। 


যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকর্ম শিক্ষা (Social Work Education in USA) 

সময় ও সমস্যার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে দান সংগঠন সমিতির কর্মীগণ তাদের কার্যাবলির উন্নয়নের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন অনুভব করেন। 

ফলশ্রুতিতে সে সময়ের বিখ্যাত সমাজকর্মী অ্যানা এল, ডয়েজ ১৮৯৩ সালে শিকাগো শহরে waroo International Congress of Charities, Correction and Philanthropy-তে সমাজকর্মের ওপর পেশাগত প্রশিক্ষণ দানের প্রস্তাব করেন।

 সমাজকর্মের অন্যতম বিশেষজ্ঞ ম্যারি রিচমন্ড সমাজসেবার উপর ব্যাবহারিক প্রশিক্ষণের জন্য Training School for Applied Philanthropy স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। 

ফলে দান সংগঠন সমিতি এবং উক্ত স্কুলের যৌথ উদ্যোগে ১৮৯৮ সালে নিউইয়র্ক শহরে ছয় সপ্তাহের এক প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা করা হয়। 

এর পরিচালক ছিলেন ‘ফিলিপ ডব্লিউ আয়ার্স’ (Philip W. Ayers) এবং এর প্রশিক্ষণার্থী ছিল ৩০ জন। 

৩ বছর পর ১৯০১ সালে এ স্কুলে ৬ মাসের প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করে New York School of Philanthrophy নামকরণ করা হয়। আর এর মাধ্যমেই সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষার সূত্রপাত ঘটে। 

পেশা হিসেবে সমাজকর্মের উন্নয়নে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ৩৫ বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দান সংগঠন সমিতি এবং Training School for Applied Philanthropy-এর উদ্যোগে যে প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল তা সমাজকর্ম পেশার উন্নয়নে সামাজিক সংশ্লিষ্টতার এক ভিন্ন প্রবাহ সৃষ্টি করে। 

পূর্বের ছয় মাসের প্রশিক্ষণ কোর্সটি ১৯০৪ সালে New York School of Social Work-এর মাধ্যমে এক বছরে উন্নীত করা হয়। 

পরে এই কোর্স কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভ করে। প্রথমে New York School of Social Work এবং আরও পরে Columbia University School of Social Work-এ উন্নীত হয়। 

নিউইয়র্ক শহরের Henry Street Settlement তখন সমাজকর্মের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবহারিক প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার হতো। 

১৯১২ সালে সমাজকর্ম স্কুলে চিকিৎসা সমাজকর্মের ওপর এক বছরের প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হয়। আরমান্ডো মরেলস তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, “চিকিৎসা সমাজকর্মীদের অন্তর্ভুক্তিকরণ পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়।” 

১৮৯১ সালে সমাজকর্মের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম জনসমক্ষে প্রচার ও জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে COS “চ্যারিটিজ রিভিউ” নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ শুরু করে। 

১৯১০ সালে এই পত্রিকার নতুন নাম রাখা হয় “দি সার্ভে”। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকা পেশাদার সমাজকর্মের তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক শিক্ষাগত উন্নয়নে এবং প্রচারে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। 

সমাজকর্ম শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্যতম অবদান রাখে ১৯২৯ সালের মিলফোর্ড কনফারেন্স। 

এই সম্মেলনের সমাজকর্ম শিক্ষার্থী, এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীগণ অনুশীলনগত শিক্ষাকে একটি ইস্যু হিসেবে উপস্থাপন করেন। 

এই সম্মেলনের অন্যতম নেতা এবং New York School of Social Work এর পরিচালক Porter Lee ব্যক্তি সমাজকর্ম শিক্ষায় মনোবিজ্ঞান, মনোচিকিৎসা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞানের সমন্বয়সাধন করেন। 

১৯৭২ সালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন হলো সমাজকর্ম শিক্ষা ও সমাজকল্যাণকে স্বেচ্ছাসেবী পর্যায়ে বিস্তার ঘটানো। 

প্রেসিডেন্ট কেনেডি এ সময় Peace Corps গঠনের লক্ষ্যে নাগরিকদের, বিশেষ করে যুবকদের আমন্ত্রণ জানায়। ফলে উৎসাহী যুবকদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয় এবং দুই বছরের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। 

উদ্দেশ্য ছিল স্বেচ্ছাসেবী পর্যায়ে সমগ্র বিশ্বের অনুন্নত দেশের কল্যাণে কাজ করা। এদের জন্য মিচিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। 

পরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের নিয়ে আমেরিকার নিজস্ব কর্মসূচি বাস্তবায়নে VISTA (Volunteer in Service to America) নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়। 

এই সংস্থার কাজ ছিল আমেরিকার অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জীবন উন্নয়নে শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক, কারিগরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা। 

এই সময়েই পেশাগত সমাজকর্মের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটতে থাকে। 

১৯২০ ও ১৯৩০ এর দশকে সমাজকর্ম ব্যক্তিভিত্তিক ও ক্লিনিক্যাল ক্ষেত্রে অগ্রগণ্যতা লাভ করে এবং ১৯৩৯ সালে P. Robinson-এর "The Changing Psychology in Social Casework." গ্রন্থের মাধ্যমে দৃঢ় রূপ ধারণ করে। 

ব্যক্তি সমাজকর্মের ধারণার ভিত্তি নির্মাণে ম্যারি রিচমন্ড এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। 

বালটিমোর COS এর জেনারেল সেক্রেটারি রিচমন্ড রচিত 'Social Diagnosis' (1917) এবং 'What is Social Casework' (1922) গ্রন্থ দুটি অনেক দিন যাবৎ সমাজকর্মের Text বই হিসেবে পাঠ্য ছিল। 

ব্যক্তি সমাজকর্মের অন্যতম আর এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন গরডন হ্যামিলটন। 

তাঁর রচিত “Theory and Practice of Social Casework” (1940) এবং 'Principle of Social Case Recording' ব্যক্তি সমাজকর্মের পদ্ধতিগত বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছে। 

হেলেন পার্লম্যানও ব্যক্তি সমাজকর্মের এক অন্যতম ব্যক্তিত্ব। মূল কথা সমাজকর্মের পদ্ধতিগত বিকাশে উপরিউক্ত মনীষীদের অবদান চিরস্মরণীয়। 

সমাজকর্ম পেশার বিকাশে অন্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো সেটেলমেন্ট মুভমেন্ট। 

১৮৯৮ এর এই সেটেলমেন্ট আন্দোলন সমাজকর্মের অন্য গুরুত্বপূর্ণ দল সমাজকর্ম পদ্ধতির বীজ বপন করেছিল। 

ফ্রিডল্যান্ডারের ভাষায়, "Became the major seedbed of the furthur growth of group work." প্রথম দিকে দল সমাজকর্ম উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম না হলেও ১৯৪৬ সালে Grace Coyle-এর উদ্যোগে বৈজ্ঞানিক রূপ ধারণ করে। 

তাঁর উদ্যোগেই ১৯৪৬ সালে Western Reserve University-তে দল সমাজকর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।

Grace Coyle-ই প্রথম সমাজকর্মের প্রক্রিয়া হিসেবে দল সমাজকর্মকে সংজ্ঞায়িত করেন। 

তিনিই দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া, গতিশীলতা এবং এ সম্পর্কিত পেশাদার নেতৃত্বগত ধারণার উন্নতি ঘটিয়ে এ বিষয়কে জনপ্রিয় করে তোলেন। ১৯৬০ এর দশকে দল সমাজকর্ম ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে প্রয়োগ হতে থাকে। 

Grace Coyle সেটেলমেন্ট হাউজ এবং YWCA-তে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। 

১৯৪৪ সালে সমাজকর্ম শিক্ষার্থীদের জন্য ৮টি মূল ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো: 

  1. ব্যক্তি সমাজকর্ম, 
  2. দল সমাজকর্ম, 
  3. সমষ্টি সংগঠন, 
  4. সামাজিক গবেষণা ও পরিসংখ্যান, 
  5. সমাজকল্যাণ প্রশাসন, 
  6. জনকল্যাণ ও শিশুকল্যাণ, 
  7. চিকিৎসা তথ্য এবং 
  8. মনোচিকিৎসা তথ্য। 

১৯৫১ সালে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে দুই বছরের মাস্টার্স প্রোগ্রাম পেশাজীবীদের জন্য হবে ন্যূনতম যোগ্যতা। 

বর্তমানে আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশে সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষা চারটি পর্যায়ে বিভক্ত: 

  • প্রথমত, কলেজ পর্যায়ে কমিউনিটি কলেজ ভিত্তিক দুই বছরের কোর্স যা Associate Degree প্রদান করে। 
  • দ্বিতীয়ত, চার বছর মেয়াদি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কোর্স যাতে স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
  • তৃতীয়ত, দুই বছর মেয়াদি Master’s ডিগ্রি প্রদান। 
  • চতুর্থত, পেশাগত ক্ষেত্রে বিশেষ জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের জন্য ডক্টরেট ডিগ্রি (Doctoral Degree) প্রদান। এছাড়াও Ph. D ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা আছে। 

সম্প্রতি DSW কর্মসূচিকে Ph.D কর্মসূচিতে পরিবর্তন করা হয়েছে। 

৫১ টি গ্র্যাজুয়েট স্কুলে বর্তমানে ডক্টরেট ডিগি (Doctoral Programs) প্রদান করা হয়। 

CSWE তথ্য অনুযায়ী ১৯৮৭ সালের নভেম্বর মাসে ৭০৩ জন পূর্ণকালীন ও ৮২০ জন খণ্ডকালীন ছাত্র ডক্টর প্রোগ্রামে শিক্ষারত ছিল। ১৯৮৬-৮৭ শিক্ষা বছরে ১৯৫ জনকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। 

DSW ডিগ্রি এবং Ph. D ডিগ্রিধারীগণ সাধারণত গবেষণা, শিক্ষকতা, প্রশাসনিক উচ্চপদ এবং সামাজিক নীতিনির্ধারণের কাজে নিয়োজিত হয়। 

NASW ১৯৮১ সালে সমাজকর্ম সম্পর্কিত শিক্ষা ও অনুশীলনের যোগ্যতা বিবেচনায় সমাজকর্মীদের চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:


১. মৌলিক পেশাদার সমাজকর্মী (Basic Professional)

এই শ্রেণির সমাজকর্মীদের Council on Social Work Education বা CSWE অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে Baccalaureate ডিগ্রি (BSW) অর্জন করতে হয়। 

এদের তাত্ত্বিক জ্ঞান, সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও সম্পর্ক স্থাপনের জ্ঞান থাকতে হয়। 


২. বিশেষজ্ঞ পেশাদার সমাজকর্মী (Specialized Professional)

এঁদের CSWE অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। 

এঁদের যে কোনো একটি বিষয়ে বিশেষ তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক শিক্ষাসহ ব্যক্তি ও দলীয় পর্যায়ের গবেষণা, প্রশাসন ও পরিকল্পনার জ্ঞান থাকতে হয়। 


৩. স্বাধীন পেশাদার সমাজকর্মী (Independent Professional)

এদের CSWE অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের MSW সার্টিফিকেট এবং স্বীকৃত ও উপযুক্ত পেশাদার ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে দুই বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা (Post master's experience) থাকতে হয়। 

এঁরা ব্যক্তিগতভাবে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করতে পারে। 


৪. অগ্রগামী পেশাদার সমাজকর্মী (Advanced Professional)

এ ধরনের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পেশাদারদের সমাজকর্মে ডক্টরেট ডিগ্রি এবং সমাজকর্ম পেশার তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক জ্ঞান, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা অথবা নীতি প্রণয়ন জ্ঞান ও গবেষণা সংক্রান্ত বাস্তব জ্ঞানের অধিকারী হতে হয়। 

এঁরা পেশার উন্নয়ন, বিশ্লেষণ, গবেষণা, নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কাজ করে থাকে।


অস্ট্রেলিয়ার সমাজকর্ম শিক্ষা (Social Work Education in Australia)

১৯২০-এর দশকের শেষ ভাগ হতে ১৯৩০-এর দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ কোর্সের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ায় সমাজকর্ম শিক্ষার সূত্রপাত ঘটে। 

প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কোর্স হিসেবে সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪০ সালে সমাজকর্ম শিক্ষা শুরু হয়। 

পরে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যাডিলেইড বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুইসল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম শিক্ষা কোর্স চালু করে। ১৯৫০ এর দশকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সমাজকর্ম শিক্ষা পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। 

তবে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অ্যাডিলেইড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪৮ হতে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মাত্র ১১৪ জন গ্র্যাজুয়েট তৈরি সম্ভব হয়েছিল। 

১৯৭০ এর দশকের প্রথম দিকে মাত্র ছয়টি প্রতিষ্ঠানে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল। 

১৯৭০ হতে ২০০৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় সমাজকর্ম স্কুলের (School of social work) সংখ্যা দাঁড়ায় ২০টিতে, যা থেকে বছরে মোটামুটি ১,০০০ এ্যাজুয়েট তৈরি হয়। 

অস্ট্রেলিয়ার সমাজকর্ম শিক্ষার ইতিহাস দীর্ঘকালের হলেও পেশা হিসেবে এর অগ্রগতি হচ্ছে ধীরগতিতে। 

ফলে নিবন্ধন বা লাইসেন্স (Registration or licensing)-এর মাধ্যমে পেশাগত মর্যাদার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। 

অস্ট্রেলিয়ার সমাজকর্ম শিক্ষার কর্মসূচিগুলো প্রায় একই ধরনের। সাধারণ শিক্ষা কোর্স চার বছর হয়ে থাকে। 

তবে সামাজিক বিজ্ঞানে ডিগ্রিধারীরা দুই বছরের কোর্স করে থাকে। পাঠ্যসূচিতে সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। 

তাছাড়া আইন, ইতিহাস, সামাজিক নীতি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্যসেবা পাঠ্যসূচির আওতাভুক্ত। সমাজকর্মের নৈতিক মানদণ্ডের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। 

সমাজকর্ম অনুশীলনের পদ্ধতি হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্ম, দল সমাজকর্ম, পরিবার সমাজকর্ম, সমষ্টি সমাজকর্ম, সামাজিক নীতি উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্ব এবং গবেষণার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। 

সমাজকর্ম শিক্ষা কারিকুলামে শিক্ষার অপরিহার্য অংশ হিসেবে মাঠ শিক্ষা (Field education) গুরুত্ব দেওয়া হয়। 

কোনো মানবসেবা প্রতিষ্ঠানে একজন পেশাদার সমাজকর্মীর আওতায় কমপক্ষে ৯৮০ ঘণ্টার মাঠ শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়, যা কমপক্ষে দুটো প্রতিষ্ঠানে দুটো ভিন্ন সমাজকর্ম পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়। 

১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘অস্ট্রেলিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব সোশ্যাল ওয়ার্কাস (AASW)’ কাঠামোর মধ্য থেকে সমাজকর্ম শিক্ষা পরিচালিত হয়। 

উল্লেখ যে অস্ট্রেলিয়ায় সমাজকর্ম এবং সমাজকর্ম শিক্ষার জন্য কোনো নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ নেই। সমাজকর্ম একটি সুনিয়ন্ত্রিত পেশা এবং তারা নিজেরাই নিজেদের নির্দেশনা ঠিক করে। 

AASW একটি বিশেষ পর্যালোচনা প্রক্রিয়ায় সমাজকর্ম শিক্ষা ব্যবস্থা অনুমোদন করে থাকে, যাতে তিন সদস্যের একটি শক্তিশালী কমিটি থাকে।

১৯৯১ সাল পর্যন্ত AASW- এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৩২৫৪ জন। প্রথম দিকে অস্ট্রেলিয়ার সমাজকর্ম শিক্ষায় তেমন গুরুত্ব ছিল না। 

তবে ১৯৫৯ সালে Murry Report-এর ভিত্তিতে সমাজকর্ম শিক্ষার দ্রুত পরিবর্তনের সূচনা হয়। 

ফেডারেল সরকারের আর্থিক সহায়তা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সহায়তার সুযোগ সৃষ্টি হয়। সমাজকর্ম স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৩টিতে উন্নীত হয়। 

সাব গ্রাজুয়েট কোর্সগুলো বাদ দিয়ে ক্রমান্বয়ে স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম চালু হতে থাকে। এই ধরনের প্রোগ্রামকে উৎসাহিত করার জন্য সমাজকর্ম পুরস্কারেরও প্রবর্তন করা হয়। 

১৯৯০ সালের পরে সমাজকর্ম শিক্ষা ও অনুশীলন দক্ষতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। যাতে ৪ বছর মেয়াদি তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক শিক্ষা গুরুত্ব পায়। 

এ ধরনের শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনে ছয়টি বিশেষ ক্ষেত্র বা উপাদান নির্ধারণ করা হয়। সেগুলো হচ্ছে: 

  • (১) ব্যক্তি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, 
  • (২) সমাজ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, 
  • (৩) সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা ও সামাজিক নীতি অধ্যয়ন, 
  • (৪) সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় অধ্যয়ন, 
  • (৫) সমাজকর্ম গবেষণা পদ্ধতি অধ্যয়ন ও 
  • (৬) সমাজকর্মের তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক দক্ষতা অর্জন এবং তার অনুশীলন। 


ভারতের সমাজকর্ম শিক্ষা (Social Work Education in India) 

প্রচলিত ধর্মভিত্তিক ও মানবপ্রেমমূলক সমাজসেবা ব্যবস্থায় বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের সর্বপ্রথম প্রয়োজন অনুভূত হয় ১৯২০ সালে। 

সমাজসেবার ক্ষেত্রে নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহরে ১৯২০ সালে Social Service League নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। 

যার উদ্দেশ্য ছিল বক্তৃতামূলক সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দ্বারা সমাজসেবার মান উন্নত করা। তবে এই ব্যবস্থা এক্ষেত্রে তেমন উন্নতি করতে সক্ষম হয় নি। 

ভারতে আধুনিক সমাজকল্যাণের সূচনাকারী হিসেবে খ্রিষ্টান মিশনারিদের অগ্রদূত (Pioneer) বলে বিবেচনা করা হয়। 

১৯২৫ সালের দিকে American Marathi Mission নামের একটি খ্রিষ্টান মিশনারি বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহরে সমাজসেবা কার্যক্রমে নিয়োজিত ছিল। এই মিশনের পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন আমেরিকার ক্লিফোর্ড ম্যানশাৰ্ড নামক এক ধর্মপ্রচারক। 

তিনি বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহরের বস্তি এলাকার জনগণের সেবা কার্যক্রম হিসেবে নাগপাদা প্রতিবেশী হাউজ নামক সংগঠনের অন্যতম কর্মী ছিলেন। 

বস্তির জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করতে গিয়ে তিনি বেশ কিছু বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন হন। যার সমাধানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ সমাজকর্মীর প্রয়োজন অনুভূত হয়। 

ক্লিফোর্ড ম্যানশাৰ্ড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ ও দায়িত্বশীল সমাজকর্মী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৩৬ সালে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহরে Sir Dorabji Tata Graduate School of Social Work প্রতিষ্ঠা করেন। 

উল্লেখ্য যে, এই প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষতায় নিয়োজিত ছিল Sir Dorabji Tata Trust. সমাজকর্মী তৈরির সর্বপ্রথম এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ক্লিফোর্ড ম্যানশার্ড স্বয়ং। 

১৯৪৪ সালে উক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'Tata Institute of Social Sciences'. এই প্রতিষ্ঠানটি আমেরিকার New York School of Social Work-এর অনুকরণে পরিচালিত হতো। 

বেসরকারি ব্যবস্থায় পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই ভারতের সমাজকল্যাণের ইতিহাসে বিজ্ঞানসম্মত সমাজকর্ম নামক একটি নতুন ধারার সূচনা হয়। সময়ের বিবর্তনে উক্ত প্রতিষ্ঠান ১৯৬৬ সালে টাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। 

টাটা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকর্ম পেশার নিয়মিত সাময়িকী হিসেবে The Indian Journal of Social Work প্রকাশ করে থাকে। 

টাটা সমাজকর্ম ইনস্টিটিউটের কার্যকারিতা ও ফলপ্রসূতার প্রেক্ষিতে এ ধরনের আরও প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। 

ফলে YWCA-এর পৃষ্ঠপোষতা ও যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তায় লক্ষ্ণৌতে আর একটি Social Work Institute প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানও আমেরিকান বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরিচালিত হতো। 

১৯৪৭-৪৮ সালে ভারতের দিল্লিতে Delhi School of Social Work নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এরপর থেকেই সমাজকর্ম নামের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যক্রম হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। 

১৯৭৯ সালে Delhi School of Social Work দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পৃথক বিভাগের মর্যাদা লাভ করে। 

১৯৫০ সালে আমেরিকার সমাজকর্ম শিক্ষা ব্যবস্থার অনুকরণে বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ে Social Work Faculty প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

এভাবে সমাজকর্ম শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সমগ্র ভারতে ১৪টি সমাজকর্ম শিক্ষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।

ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ভারতে ৩৫টি সমাজকর্ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিল। 

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্মে M. Phil এবং Phd. ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে সমগ্র ভারতের ১৪০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক সমাজকর্ম বিভাগ চালু রয়েছে। 

সরকারি উগ্যোগে ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে ১৯৫৫ সালে Social Welfare in India নামক একটি তথ্যবহুল বিরাট গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। 

এই বইয়ে আধুনিক সমাজকল্যাণের ধারণা, সমাজকল্যাণ নীতি ও কর্মসূচি এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত আলোচনা ছিল। 

পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে উপরিউক্ত গ্রন্থের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে ভারতে Encyclopedia of Social Work প্রকাশিত হয়। 

আরও পরে ১৯৮৭ সালে আমেরিকার সমাজকর্ম বিশ্বকোষের অনুসরণে নতুন ভাবে চারটি খণ্ডে ভারতীয় Encyclopedia of Social Work প্রকাশিত হয়।

ভারতীয় সমাজকর্মীগণ আমেরিকায় গিয়েও পড়ালেখা ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করত। 

কিন্তু আমেরিকার প্রতি ভারতের নির্ভরতা এত বেশি বেড়ে যায় যে, Encyclopedia প্রকাশে এবং সমাজকর্মীদের Code of Ethics নির্ধারণেও আমেরিকান ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ করা হয়। এমনকি সমাজকর্ম পাঠ্যক্রম নির্ধারণেও ব্যতিক্রম ঘটে নি। 

তাছাড়া দীর্ঘদিনের পথ পরিক্রমার পরেও ভারতের নিজস্ব আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদের নিজস্ব টেক্সট বইও তেমন প্রকাশিত হয়নি। 

Encyclopedia of Social Work পাঠ করলেও ভারতীয় সমাজকর্ম ব্যবস্থার তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। এখনও ভারতের ছাত্রশিক্ষক মহলে পঠিত বইয়ের ৯০ শতাংশই আমেরিকার। 

এ ধরনের নির্ভরশীলতার কারণে বলা হয়ে থাকে যে, “ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকর্ম সাহিত্য থেকে সমাজকর্মের সুগঠিত ধারণা, নীতি, তত্ত্ব এবং কৌশলসমূহ তৈরি অবস্থায় অর্জন করেছে।” 


শ্রীলংকার সমাজকর্ম শিক্ষা (Social Work Education in Sri Lanka) 

শ্রীলংকার সমাজকর্ম শিক্ষার ইতিহাস বেশ দীর্ঘদিনের। ১৯৫২ সালে সে দেশের সমাজকর্ম শিক্ষা শুরু হয়। তবে শ্রীলংকার সমাজকর্ম শিক্ষা অগ্রসর হয়েছে খুব ধীরগতিতে। 

এমনকি এখনও সমগ্র দেশব্যাপী এর বিস্তৃতি ঘটেনি। সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন National Institute of Social Development (NISD) সমাজকর্ম শিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান। 

উল্লেখ্য যে, এখন পর্যন্ত এটিই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে সমাজকর্মের ওপর পেশাগত শিক্ষা (Social Work professional education) প্রদান করা হয়ে থাকে। 

২০০৪ সালের সুনামি দুর্যোগের (Tsunami disaster) পূর্ব পর্যন্ত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকর্মের অনুশীলন ক্ষেত্র নিয়ে কোনো চিন্তা করে নি। অধিকাংশ মানুষই সমাজকর্ম ও সমাজবিজ্ঞানের পার্থক্য বুঝত না। 

NISD সমাজকর্ম শিক্ষাক্ষেত্রে তিন পর্যায়ের কোর্স পরিচালনা করে থাকে। সেগুলো হচ্ছে সমাজকর্মে ডিপ্লোমা, সমাজকর্মে স্নাতক ডিগ্রি এবং মাস্টার্স ডিগ্রি। দুই বছর মেয়াদের পূর্ণকালীন ডিপ্লোমা কোর্স শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। 

২০০৫ সালে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (UGC) অনুমোদনের মাধ্যমে স্নাতক ডিগ্রি (BSW) প্রদানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা পায়। পরে ২০০৮ সাল থেকে সমাজকর্মে মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু হয়।

উপর্যুক্ত তিনটি কোর্সের শিক্ষাক্রমেই শ্রেণিকক্ষভিত্তিক তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন এবং ফিল্ডভিত্তিক ব্যাবহারিক দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা বিদ্যমান। 

তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি, পরিবার, দল, সমষ্টি ও সংগঠনের সাথে কাজ করার জন্য মানব আচরণ ও সমাজকর্ম পদ্ধতির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ফিল্ডওয়ার্ক পরিচালিত হয় NISD-এর স্কুল অব সোশ্যাল ওয়ার্ক সমন্বয়কারীর দ্বারা। 

ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন সমাজকল্যাণ সংস্থা এবং এনজিওতে ব্যক্তি, দল ও সমষ্টি সমাজকর্মের, অনুশীলনের জন্য পাঠানো হয়।

বর্তমানে প্রায় ১,৫০০ সমাজকর্মী বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছে। অথচ সেখানে হাজার হাজার পেশাগত সমাজকর্মীর প্রয়োজন বিদ্যমান। 

মানসিক হাসপাতাল, স্কুল, জেলখানা, শিশুকল্যাণ, অপরাধ সংশোধন, শিল্পকারখানা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সমাজকর্মীর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে। 

তবে পেশাগত সমাজকর্ম হিসেবে নিবন্ধন ও লাইসেন্স প্রদানের কোনো ব্যবস্থা নেই। 

তবে Sri lanka Association of Professional Social Workers (SAPSW) পেশাদার সমাজকর্মীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে। 


দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজকর্ম শিক্ষা (Social Work Education in South Korea)

দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজকর্ম শিক্ষা ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনুসরণ করা হয়। সর্বপ্রথম আমেরিকার অনুসরণে মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়। 

পরে চার বছর মেয়াদি স্নাতক (BSW) কোর্স চালু হয়। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজকর্ম শিক্ষা যথেষ্ট উন্নত ও পেশাধর্মী। 

সমাজকর্মের তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যাবহারিক দক্ষতা অর্জনকেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। 

বিশেষ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও দক্ষ সমাজকর্মীর তত্ত্বাবধানে সে দেশের ফিল্ডওয়ার্ক ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। 

দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজকর্ম শিক্ষা পাঠ্যক্রমে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 

ব্যক্তি সমাজকর্ম, দল সমাজকর্ম এবং সমষ্টি সমাজকর্ম ছাড়াও ক্লিনিক্যাল অনুশীলন সম্পর্কিত দক্ষতা অর্জনকে শ্রেণিকক্ষ এবং মাঠপর্যায়ে বিস্তৃত করা হয়েছে। মানব আচরণ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন সেখানকার পাঠ্যক্রমের অপরিহার্য অংশ। 

অনেক সমাজকর্মী, সমাজ গবেষক, সমাজকর্ম প্রশাসক এবং সামাজিক নীতি ও পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ হিসেবেও বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে থাকে। 

দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজকর্ম শিক্ষা ব্যবস্থায় অ্যাডভান্স কোর্সেরও যথেষ্ট সুযোগ বিদ্যমান। এমফিল এবং ডক্টরেট ডিগ্রিরও বিশেষ ব্যবস্থা আছে। 

সেখানকার সমাজকর্ম শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। সমাজকর্ম শিক্ষা সম্পর্কিত গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ সুযোগ প্রদান করা হয়। 

১৩ শতাংশ সমাজকর্মী সমস্যা বিশ্লেষণ ও হস্তক্ষেপের সময় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে। কোরিয়ার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় সমাজকর্মীদের প্রয়োজন যেমন বাড়ছে, তেমনি জ্ঞান ও দক্ষতার কার্যকারিতাও বাড়ছে। 

দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজকর্ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও চাহিদাভিত্তিক নতুন ধারণা ও জ্ঞান অন্বেষণে কাজ করে চলেছে। 

কোরিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব সোশ্যাল ওয়ার্কাস (KASW) সেখানকার শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। সমাজকর্মীদের নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার কাজও এই সংস্থা করে থাকে। 

Korean American Social Work Educators Association (KASWEA) শিক্ষা ও শিক্ষাক্রমের মান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। 

সেদেশের সমাজকর্ম শিক্ষার প্রচার ও জনপ্রিয়তার জন্য The International Journal of Continuing Social Work Education বছরে তিনবার প্রকাশিত হয়। 

দক্ষিণ কোরিয়ায় সমাজকর্ম গবেষণার জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ দায়িত্ব পালন করে থাকে। 


জাপানের সমাজকর্ম শিক্ষা (Social Work Education in Japan) 

১৯২০ এর দশক থেকে জাপানে সমাজকর্ম শিক্ষা চালু রয়েছে। বর্তমানে সেদেশের সমাজকর্ম শিক্ষা পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে যথেষ্ট উন্নত হিসেবে স্বীকৃত। 

১৯৮৭ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ব্যবস্থায় (State certification System) সফল অনুমোদিত সমাজকর্মী তৈরি হচ্ছে। তবে সমাজকর্ম পেশার স্বীকৃতির বিষয়ে এখনও সামাজিক অপর্যাপ্ততা বিদ্যমান। 

সমাজকর্ম শিক্ষার মান উন্নয়ন ও পাঠ্যক্রম প্রণয়নের ক্ষেত্রে Japanese Association of Schools of Social Work (JASSW) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

এই সংস্থা ২০০৯ সালে ‘সমাজকর্ম শিক্ষার বিশ্বা প্রশিক্ষণ’ বিষয়ে একটি প্রকাশনা বের করেছে, যা পরে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ ও স্প্যানিস ভাষায় অনূদিত হয়েছে। 

সমাজকর্ম সংস্থাটি ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সদস্য স্কুলগুলোর অনুমোদন মান ও শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। 

২০১০ সালের তথ্য অনুযায়ী জাপানে কমিউনিটি কলেজে দুই বছরের সমাজকর্ম কোর্স চালু রয়েছে। 

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর মেয়াদি স্নাতক কোর্স এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স কোর্স হিসেবে দুই বছরের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। 

সেখানে সমাজকর্ম শিক্ষাক্ষেত্রে ২ বছরের কলেজ কোর্স ১৩টি, ৪ বছরের বিশ্ববিদ্যালয় কোর্স ১৪৮টি, মাস্টার্স কোর্স (MSW) ৯১টি, ডকটোরাল কোর্স ২টি এবং ১টি বিশেষায়িত কোর্সের ব্যবস্থা আছে। 

এছাড়া গবেষণা, বিশেষায়িত পেশাদার অনুশীলন প্রশিক্ষণ, সমাজকর্ম পেশার অনুমোদনের ব্যবস্থা বিদ্যমান। 

২০১০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত জাপানে ১,২২,৩৮২ জন অনুমোদিত সমাজকর্মী (Certified Social Workers) ছিল। 

উক্ত সময়ে সেখানে ৪৩,৪৭২ জন সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত মনোচিকিৎসা সমাজকর্মী ছিল। জাপানের কয়েকটি সমাজকর্ম সংগঠন নিম্নরূপ:

১. Japanese Association of Certified Social Worker. 

২. Japanese Association of Certified Psychiatric Social Workers. 

৩. Japanese Association of Certified Social Worker in Health Services.

৪. Japanese Association of Certified Social Workers. 


উপরিউক্ত চারটি সংগঠনই আন্তর্জাতিক সমাজকর্মী ফেডারেশন (IFSW) এর সদস্য। 


চীনের সমাজকর্ম শিক্ষা (Social Work Education in China) 

আধুনিক বিশ্বে সমাজকর্ম শিক্ষা পেশাগত শিক্ষার একটি অপরিহার্য অংশ। অধিক জনসংখ্যা, শিক্ষা ব্যবস্থার পশ্চাৎপদতা, কৃষি অর্থনৈতিক নির্ভরতা, পরিবার ও সমাজের ব্যাপক পরিবর্তনশীলতা প্রভৃতি কারণে সমাজকর্ম ও সমাজকর্ম শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে সমাজকর্ম শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে।

১৯৪৮ সালে সে দেশে সমাজকর্ম শিক্ষা চালু হয় এবং ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম প্রোগ্রাম চালু ছিল। 

১৯৯৪ সালে সেখানে China Association of Social Work Education (CASWE) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। চীনের সমাজকর্ম শিক্ষা ক্ষেত্রে পরামর্শক হিসেবে IASSW এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সহযোগিতা করে। 

তাছাড়া ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে স্ক্যানডিনেভিয়ার সমাজকর্ম বিশেষজ্ঞগণ চীনকে সহযোগিতা করে। 

১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত বেইজিং আঞ্চলিক সেমিনারে সমাজকর্ম শিক্ষা কর্মসূচি এবং শিক্ষার্থীদের আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধি করাকে জোর দেওয়া হয়েছিল। 

চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৪ বছর মেয়াদি স্নাতক কোর্স এবং ১ বছর মেয়াদি মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। M. Phil এবং ডক্টরেট ডিগ্রিরও ব্যবস্থা আছে। 

১৯৮৮ সালে চীনে China Association of Social Work (CASW) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরে ১৯৯২ সালের জুলাই মাসে IFSW-এর সদস্যপদ লাভ করে। 

চীনের সমাজকর্ম শিক্ষাক্রমে ব্যক্তি সমাজকর্ম, দল সমাজকর্ম, সমষ্টি সমাজকর্ম ও সমাজকর্ম প্রশাসনকে পদ্ধতির মর্যাদা দেওয়া হয়।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url