নারী শিক্ষা আন্দোলন (Women Education Movement)

অবিভক্ত বাংলার অবহেলিত, বঞ্চিত, অজ্ঞ ও সামাজিক অসচেতন নারীসমাজের জাগরণ ও মুক্তির আলোকবর্তিকা হাতে বেগম রোকেয়ার আবির্ভাব। 

মুসলমান নারীগণ সে সময় সামাজিক রক্ষণশীলতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুকতার কারণে গৃহকোণে বদ্ধ জীবনযাপন করতে বাধ্য হতো। 

সেই সময় অবরোধবাসিনী বৃহৎ নারীসমাজের প্রগতি ও জাগরণের মশাল হাতে কাজ শুরু করেন মহীয়সী বেগম রোকেয়া। 


নারী শিক্ষা আন্দোলন (Women Education Movement) 

Women Education
চিত্র: বেগম রোকেয়া। জন্ম- ০১/১২/১৮৮০ এবং মৃত্যু- ০৯/১২/১৯৩২।

শিক্ষাক্ষেত্রে ফয়জুন্নেছার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে গেছেন। 

নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে তার স্থান ছিল বেগম রোকেয়ার পরেই। সর্বপ্রথম তিনি নিজের গ্রামের মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। 

এছাড়া কুমিল্লা শহরে একটি পাঠশালা এবং একটি গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি নিজ গ্রামে একটি সিনিয়র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এই মাদ্রাসা ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজে রূপান্তরিত হয়েছে। 

এই কলেজের নিকটে অবস্থিত কন্যার নামে প্রতিষ্ঠিত বদরুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাও তার কীর্তির স্বাক্ষর। 

উল্লেখ্য যে, নারীশিক্ষার আলোর দিশারি বেগম রোকেয়ারও তিনি পথপ্রদর্শক ছিলেন। কারণ তারও বহুপূর্বে ফয়জুন্নেছা পর্দানশীল মহিলাদের জন্য উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে চরম দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। 


মহীয়সী বেগম রোকেয়া

সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের বিচারে বেগম রোকেয়াকে নারী শিক্ষার অগ্রদূত বলা হয়। 

তবে বাংলাদেশের জনকল্যাণ ও সমাজসেবার ক্ষেত্রে এই বিদূষী ও মহৎপ্রাণ নারীর ভূয়সী প্রশংসা না করে পারা যায় না। 

আধুনিককালে অনেক নারী অনেক চমক নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন কিন্তু সামগ্রিক বিচারে তার ধারেকাছে যেতেও সক্ষম হয় নি।

রোকেয়া খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, নারীজাতির মুক্তির ও অধিকার আদায়ের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ পথ হলো নারী শিক্ষা। 

স্বামীর অকালমৃত্যুর পর বেগম রোকেয়া অগাধ সম্পত্তির মালিক হন। তিনি এ সমস্ত সম্পত্তি নারীশিক্ষা ও নারী জাগরণে ব্যয় করার সংকল্প করেন। 

১৯০৯ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে নারীশিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি কাজ শুরু করেন। 

কিন্তু পারিবারিক কলহের কারণে তার প্রাণপ্রিয় স্কুল ও ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হন। 

যার অন্তরে নারীশিক্ষার ঝংকার সে বিপদে ধৈর্য হারাবেন কেন? তিনি ১৯১১ সালের ১৬ই মার্চ পুনরায় কলকাতার এক ক্ষুদ্র গলিতে ৮ জন ছাত্রী নিয়ে “সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল” স্থাপন করেন। 

প্রথম অবস্থায় ছাত্রী সংগ্রহে ব্যর্থ হলেও দমবার পাত্রী তিনি ছিলেন না। সামাজিক কুৎসা ও নিন্দাকে উপেক্ষা করে তিনি শিক্ষার প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ (Motivate) করতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

১৯১১ সালে যে প্রতিষ্ঠানের শুরু হয়েছিল মাত্র ৮ জন ছাত্রী নিয়ে ১৯১৫ সালে সেখানে ছাত্রী সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৫ জন। 

পরবর্তীতে এই স্কুলের সুনামে মুগ্ধ হয়ে এগিয়ে আসেন বেগম সুলতানা জাহান, মওলানা মুহাম্মদ আলী ও ফজলুল হকের মতো ব্যক্তিত্ব। 

১৯১৭ সালে তৎকালীন বড়লাট পত্নী লেডি চেমসফোর্ড রোকেয়ার স্কুলের অসাধারণ কীর্তি দেখে মুগ্ধ হন এবং স্কুলটিকে ইংরেজি স্কুলে উন্নীত করার ব্যবস্থা করেন। 

পরে ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে উক্ত স্কুলটি সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। মোরসেদ সফিউল আলম “বেগম রোকেয়া সময় ও সাহিত্য” গ্রন্থে বলেছেন, “কর্মী রোকেয়া, শিক্ষাব্রতী রোকেয়া, সংস্কারক রোকেয়া ও সৈনিক রোকেয়াকে চিনতে হলে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের প্রতিষ্ঠাত্রী ও পরিচালিকা বেগম রোকেয়াকে বুঝতে হবে।” 

১৯২৯ সালে রোকেয়ার প্রচেষ্টায় কলকাতায় “মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল” নামে আর একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। 

মুসলিম বাংলায় নারী জাগরণের ও নারীমুক্তির অগ্রদূত হিসেবে রোকেয়া তার উদ্দেশ্যের সফলতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। 

তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই চ্যালেঞ্জকে কার্যকরী করতে হলে মুসলিম মহিলাদের সংগঠিত করতে হবে। 

তাই ১৯১৬ সালে “আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম” নামে একটি মুসলিম মহিলা সমিতি স্থাপন করেন। 

এই সমিতির উদ্দেশ্য ছিল নারীজাগরণ এবং দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। যার ফলশ্রুতি হলো সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুসলিম নারীর বর্তমান কর্মচাঞ্চল্য। 

পরবর্তীতে এই সমিতি মুসলমান মহিলাদের মুখপাত্র হিসেবে ১৯৩৬ সালে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নারী কল্যাণ সম্পর্কিত আলোচনায় অংশগ্রহণ করে রোকেয়ার কর্মজীবনের ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে। 

এছাড়া “নিখিল ভারত মুসলিম মহিলা সমিতি” “বেঙ্গল উইমেন্স এডুকেশনাল কনফারেন্স” “নারী তীর্থ সংস্থা” প্রভৃতি সমিতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে বেগম রোকেয়া নারী জাতির সেবা করে গেছেন। 

সাহিত্য সমাজজীবনের দর্পণস্বরূপ। সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি নারী জাতির তৎকালীন দুরবস্থা ও করণীয় সম্পর্কে সচেতন করার প্রয়াস চালান। 

তিনি তার তীক্ষ্ণধার লেখনী শক্তি দ্বারা একদিকে যেমন রক্ষণশীল পুরুষ সমাজের ভুল ভাঙ্গাতে চেয়েছিলেন তেমনি নারীদের আপন অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামী হতে শিখিয়েছেন। 

তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর উল্লেখযোগ্য। নারী অধিকার সম্পর্কে তিনি তার মতিচুর গ্রন্থেই উল্লেখ করেছেন যে, কন্যাগুলোকে সুশিক্ষিত করিয়া কর্মক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক। 

তার সাহিত্যকর্মের আলোচনা প্রসঙ্গে ড. আনিসুজ্জামান তার ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে বলেছেন যে, “বেগম রোকেয়া বিদ্রুপের শানিত কষাঘাত নিয়ে মাঠে নামলেন এবং আক্রমণ করলেন ব্যক্তিকে নয় সমাজের মনোবৃত্তিকে।” 

মূলত বেগম রোকেয়ার সাহিত্যকর্মে ছিল জাগরণের বাণী, কূপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, সামাজিক প্রচলিত মনোভাবের প্রতি তীর্যক কটাক্ষ ও বিদ্রুপ এবং রূপক ব্যবহারের মাধ্যমে কর্ম প্রতিভা ও কর্মশক্তির বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করা।

নারী-পুরুষের সম্পর্ক বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি তার মতিচুর গ্রন্থে বলেন, “বালক ইচ্ছা করিলে পুতুলকে প্রাণপণে ভালবাসিতে পারে, পুতুল হারাইলে বিরহে অধির হইতে পারে। 

পুতুলের ভাবনায় অনিদ্রায় রজনী যাপন করিতে পারে, হারানো পুতুল ফিরিয়া পাইলে আহ্লাদে আটখানা হইতে পারে, আবার বিনা কারণে রাগ করিয়া পুতুলটা কাদায় ফেলিয়া দিতে পারে। কিন্তু পুতুল বালকের কিছুই করিতে পারে না।” 

নারী স্বাধীনতা ও অধিকারের বিষয়ে তিনি ইউরোপেরও সমালোচনা করে পদ্মরাগ উপন্যাসে বলেছেন, “ইংল্যান্ডের আইন হেলেনদিকে বাতলের বন্ধন হইতে মুক্তিদান করিতে পারিল না। এই ইংল্যান্ড-পুঁতিগন্ধময় পচা ইংল্যান্ড। 

নারী অধিকার ও নারী শিক্ষা সম্পর্কে তিনি বলতেন, “আমরা লেডি কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টার, লেডি জজ-সবই হইব। 

পঞ্চাশ বৎসর পর লেডি ভাইসরয় দেখিয়া পুরুষের চোক্ষে ধাঁধা লাগিবে।”

পরিশেষে বলা যায়, বঙ্গীয় মুসলিম নারীদের শিক্ষার মাধ্যমে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনয়নে এবং সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় রোকেয়ার অবদান দীপশিখার মতো এখনো সমুজ্জ্বল। 

কারণ বেগম রোকেয়ার জন্ম না হলে বাঙালি নারীসমাজ অবরোধের বেড়াজাল পেরিয়ে আজ এই পর্যায়ে আসতে পারত কিনা সন্দেহ।

সমাজসেবা: মানব সম্পদের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট এবং আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট সেবা ব্যবস্থা। 

সামাজিক বিমা: বার্ধক্য, অসুস্থতা, বেকারত্ব, দুর্ঘটনা কিংবা অক্ষমতাজনিত দুরবস্থা দূরীকরণের বিশেষ ব্যবস্থা। 

ঐতিহ্যগত সমাজকল্যাণ: মানবপ্রেম, ব্যক্তিগত স্বতঃস্ফূর্ততা, অস্থায়ী ও সীমিত পরিসরের সমাজসেবা ব্যবস্থাকে ঐতিহ্যগত সমাজকল্যাণ বলে।


সমাজসংস্কার আন্দোলন (Social reform movement)

সামাজিক কুপ্রথা ও কুসংস্কার দূরীকরণের লক্ষ্যে গৃহীত আন্দোলন।


প্রত্যয় (Conviction)

প্রত্যয় হচ্ছে কোনো বিস্তৃত ঘটনার সংক্ষিপ্ত নাম বা প্রতীক যা বিস্তৃত ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন সমাজকর্ম। 


সুপ্ত প্রতিভা (Latent Talent)

ব্যক্তির এমন কতিপয় গুণাবলি যা উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে ব্যক্তি মানসে লুক্কায়িত বা অপ্রকাশিত থাকে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url