বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার বিকাশে সমস্যাসমূহ | Problems of Social Work Profession Development in Bangladesh

সমাজের প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের জীবনে আশার আলো জ্বালাতে কাজ করে সমাজকর্মীরা। দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, অপরাধ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মাদকাসক্তি, পারিবারিক সমস্যা, প্রতিবন্ধীতা, বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের মতো বহুবিধ সামাজিক সমস্যা সমাধানে তাদের ভূমিকা অপরিসীম।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমাজকর্ম পেশার বিকাশ ও সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলেও, এ পেশার সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান না হলে পূর্ণাঙ্গভাবে সমাজকর্ম পেশার বিকাশ সম্ভব নয়।

এই আর্টিকেলে আমরা বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার বিকাশে বিদ্যমান কিছু প্রধান সমস্যার উপর আলোকপাত করবো এবং সমাধানের সম্ভাব্য উপায় তুলে ধরবো।

আর্থ-সামাজিক জটিলতা, পুরাতন সমস্যাগুলোর আত্মপ্রকাশ এবং নতুন নতুন সমস্যা এদেশের সমাজ জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। 

ফলে ১৯৫৩ সালে তৎকালীন সরকারের প্রচেষ্টায় এবং জাতিসংঘের সহায়তায় এদেশে সমাজকর্মের আবির্ভাব ঘটে। 

পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশে আমেরিকাই সবচেয়ে অগ্রসর দেশ। তাই এক্ষেত্রে প্রথম থেকেই আমেরিকার মডেল অনুসৃত হতে থাকে। 


বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার বিকাশে সমস্যাসমূহ

Profession Development

Problems of Social Work Profession Development in Bangladesh 

প্রথম দিকে সমাজকর্ম পেশার বিকাশে এবং অনুশীলনে একটি বিশেষ গতিধারা ছিল। কিন্তু নানা কারণে সেই গতিধারা বাধাগ্রস্ত হয়, যা সাম্প্রতিককালেও বিদ্যমান। 

অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বর্তমানে সমাজকর্ম পেশার বিকাশ ঘটছে হিমবাহ গতিতে। আর এই গতির পিছনে কাজ করছে বহুমুখী সমস্যা। বিশেষজ্ঞ দৃষ্টিতে সমস্যাগুলো নিম্নরূপ:


১. ঐতিহ্যগত চিন্তাধারা (Traditional thinking)

শত শত বছর ধরে এদেশে ঐতিহ্যগত সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এখনও এদেশের মানুষ সমাজকর্মী বলতে দানশীল, বিপদের সময় ত্রাণদাতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল স্থাপনকারী, স্বেচ্ছাসেবায় রাস্তাঘাট নির্মাণকারীদের বুঝে থাকে। 

বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মে BSS (Honours) এবং MSS কোর্স চালু রয়েছে। অথচ এই বিষয় বহির্ভূত এমনকি সমাজকর্মের ছাত্রছাত্রীগণও সমাজকর্ম পেশার সাম্প্রতিক অগ্রগতি সম্পর্কে সচেতন নয়। 

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও একটি বিরাট অংশ সমাজকর্মের পেশাদার রূপ সম্পর্কে সচেতন নয়। 

যার জ্বলন্ত প্রমাণ সমাজসেবা অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পে সমাজকর্মীদের নিয়োগের ন্যূনতম অগ্রাধিকার না দেওয়া।


২. শিক্ষা উপকরণের অভাব (Lack of Educational materials)

সমাজকর্মের যাত্রাপথে অর্ধশতাব্দী সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। কিন্তু সমাজকর্মের তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক জ্ঞান অর্জন উপযোগী গবেষণামূলক দেশীয় গ্রন্থের তেমন বিকাশ ঘটেনি। 

এখনও সমাজকর্মের শিক্ষক ও ছাত্রগণ আমেরিকা ও ব্রিটেনের বই-পুস্তক নির্ভর। পেশাগত পরিচিতি ও প্রচারের ক্ষেত্রে জাতীয় প্রচার মাধ্যমগুলো বিশেষ অবদান রাখতে পারে। 

কিন্তু প্রচেষ্টার অভাবে জাতীয় প্রচার মাধ্যমগুলোতে সমাজকর্ম সম্পর্কিত কোনো প্রবন্ধও প্রকাশিত হতে দেখা যায় না। 

তিন মাসে একবার হলেও প্রচার মাধ্যমগুলোতে সমাজকর্মের পাতা শিরোনামে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা যায়। 

বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি অনুযায়ী শিক্ষা উপকরণের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের মুষ্টিমেয় শিক্ষকের মহৎ প্রচেষ্টায় কিছু পাঠ্যবই প্রকাশিত হলেও তা দুই-তিন দশক পূর্বের ধারণা ও তত্ত্বভিত্তিক। 


৩. পাঠ্যক্রমের মান (Curriculum standards)

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যক্রম আন্তর্জাতিক মানের হলেও ব্যাবহারিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে Field Work ব্যবস্থা পেশাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়। 

Field Work (Field practicum)-এর সময় সংক্ষিপ্ততা তত্ত্বাবধানকারীর এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীর ক্ষেত্র নির্বাচন ও দায়িত্ব পালন মনোভাব পরিবর্তিত হওয়া দরকার। 

কলেজ পর্যায়ের BSS ও MSS পাঠ্যসূচির দুর্বলতা এবং শিক্ষক স্বল্পতাও সমাজকর্ম পেশার আর একটি সমস্যা। 


৪. শিক্ষা কার্যক্রমের সমন্বয়হীনতা (Incoherence of educational programs)

একই দেশের উচ্চশিক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ এবং রাজশাহী ও সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম নামকরণ সমাজকর্ম পেশার বিকাশে বাধা ও ধাধার সৃষ্টি করছে। 

রাজশাহী ও সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্মে MSS ডিগ্রিধারীগণ যখন কলেজ পর্যায়ে সমাজকল্যাণের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে চায় কিংবা নিয়োগ পায় তখনও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। 

বিশ্ববিদ্যালয় এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের সাথে সমন্বয়হীনতাও সমাজকর্ম পেশার বিকাশের অন্যতম বাধা। 


৫. পেশাগত সংগঠনের অভাব (Lack of professional organization)

যে কোনো পেশার সময় উপযোগী মান উন্নয়ন, ব্যাপক প্রচার, অনুশীলনের ক্ষেত্র সৃষ্টি এবং পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য শক্তিশালী ও পেশার প্রতি আনুগত্যশীল সংগঠন অপরিহার্য। 

আমরিকায় NASW এবং ACSW এর মতো শক্তিশালী সংগঠন সমাজকর্মের উন্নয়নে সদা তৎপর। 

অথচ সুদীর্ঘ ৫০ বছর পরও বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার ক্ষেত্রে তেমন শক্তিশালী কোনো সংগঠন গড়ে ওঠেনি। 

জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি এবং সমাজকর্ম শিক্ষক সমিতি নামে সংগঠন থাকলেও আশানুরূপ দায়িত্ব পালন করতে পারে নি। বর্তমানে সংগঠনগুলো মৃতপ্রায়। 

পেশাগত মর্যাদার লড়াইয়ে শক্তিশালী ও পেশার উন্নয়নে আত্মনিয়োগকারী সংগঠনের কোনো বিকল্প নেই। 

সংগঠনের মাধ্যমে পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রণ, নৈতিক মানদণ্ড ভঙ্গকারীদের শাস্তির ব্যবস্থা এবং পেশার সময় উপযোগী উন্নয়নের ব্যবস্থা না থাকলে স্বীকৃত পেশাও পতনের সম্মুখীন হয়। 


৬. অনুশীলন ক্ষেত্রের সমস্যা (Practice field problems)

উন্নত দেশসমূহে বর্তমানে সমাজকর্মের অনুশীলনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও পরিবারভিত্তিক ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস শুরু হয়েছে। 

যা Micro সমাজকর্মের আওতাভুক্ত। তাছাড়া Macro Social Worker গণসমষ্টি সংগঠনের ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। 

ফলে পেশার যেমন ব্যাপক পরিচিতি ঘটছে তেমনি পেশার গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে। অনুশীলনগত সুনাম যে কোনো পেশার মর্যাদার অন্যতম পরিচায়ক। 

বাংলাদেশের সমাজকর্মীগণ এ ধরনের সুযোগ হতে প্রায় বঞ্চিত। ব্যক্তি সেবা, পারিবারিক সেবা, দলীয় উন্নয়ন, অপরাধ সংশোধন, এ মনোচিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রসমূহে বিশেষজ্ঞ সমাজকর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা নেই। 

কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজকর্মীদের নিয়োগ করা হলেও পেশাদার-অপেশাদার এবং দক্ষ-অদক্ষের পার্থক্য না থাকায় দক্ষ সমাজকর্মীগণ উৎসাহ ও পেশাগত মনোবল হারিয়ে ফেলে। ফলে সমাজকর্মী হয়েও সমাজকর্মের জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োগের প্রয়োজন মনে করে না।


৭. পেশাগত নৈতিক মানদণ্ডহীনতা (Lack of professional ethics)

যে কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধ, সংস্কৃতি এবং লোকাচারের ভিত্তিতে পেশার স্বতন্ত্র নৈতিক মানদণ্ড অপরিহার্য। বাংলাদেশের সমাজকর্ম পেশার সুনির্দিষ্ট অনুশীলন ব্যবস্থাও, নেই নৈতিক মানদণ্ডও নেই। 

NASW এবং IFSW-এর নৈতিক মানদণ্ডগুলোকে ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবহারের বিধান থাকলেও এগুলোর ব্যবহারগত নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির কোনো সুনির্দিষ্ট সংগঠন নেই। 


৮. সামাজিক অনুমোদন সমস্যা (Social approval issues)

বাংলাদেশের মতো একটি সমস্যা জর্জরিত দেশে সমাজকর্মের ব্যাপক অনুশীলনের সুযোগ সৃষ্টি হলে সমাজকর্মীগণ জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হতো। 

সামাজিক অনুমোদন যেমন পেশার মর্যাদার জন্য অপরিহার্য তেমনি পর্যবেক্ষণযোগ্য ও পরিমাপযোগ্য সেবাকার্য যে কোনো উচ্চমানসম্পন্ন বৃত্তিকে পেশাগত অনুমোদনে সহায়তা করে। 

এক্ষেত্রে সরকারের কল্যাণমুখী রাষ্ট্রনীতি এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও সমাজকর্ম পেশার উন্নয়নে সহায়তা করতে পারত। 

কিন্তু সমাজ, রাষ্ট্র এবং সমাজকর্ম এই তিন শক্তির সমন্বয়ের ক্ষেত্র সৃষ্টি না হওয়ায় সমাজকর্ম পেশা এখনও সমস্যাগ্রস্ত। 

বাংলাদেশের মতো একটি সমস্যাবহুল অথচ সম্ভাবনাময় দেশে বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন সমাজকর্মীর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। 

সমাজকর্ম নামের এই শিশু পেশাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিলে সমাজকর্মীগণ আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। 

সমাজকর্ম অনুশীলনের পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করা হলে স্বাভাবিকভাবেই উল্লিখিত সমস্যগুলোর সমাধান হতে পারে। তবে পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার উন্নয়নেও সমাজকর্মীদের আরও অগ্রসর হতে হবে। 

উল্লেখিত সমস্যাগুলো সমাধানে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পেশাগত সংগঠন এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষকে একসাথে কাজ করতে হবে। 

সমাজকর্ম পেশার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি, দক্ষ সমাজকর্মী তৈরি, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, পেশাগত সংগঠনের শক্তিশালীকরণ, গবেষণা ও জ্ঞান ভান্ডার তৈরি এবং সমাজকর্মীদের ন্যায্য বেতন ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার বিকাশ সম্ভব।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url