বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার সম্ভাব্য প্রয়োগক্ষেত্র (Possible Fields of Social Work in Bangladesh)

বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। ১৯৫২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বিভিন্নমুখী সামাজিক সমস্যার কার্যকরী সমাধান এবং সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘের স্মরণাপন্ন হয়। 

ফলে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ দল এদেশে পেশাদার সমাজকর্মী পরিচালিত কর্মসূচির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। 

ফলশ্রুতিতে সমাজকর্ম শিক্ষা এবং সমাজ উন্নয়ন কর্মসূচির বিকাশ ঘটতে থাকে। ক্রমবিবর্তনের ধারায় দেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিষয়ে অনার্সসহ মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। 

এ সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন সমাজকর্মের বিশেষজ্ঞও তৈরি হচ্ছে। 

অন্যদিকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদপ্তর বিভিন্ন ধরনের সমাজকল্যাণ কর্মসূচিও পরিচালনা করে আসছে। 

তাছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন (NGO) এবং আন্তর্জাতিক সংগঠন সমাজকল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। যা বাংলাদেশে সমাজকর্মের প্রয়োগক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত। 


বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার সম্ভাব্য প্রয়োগক্ষেত্র (Possible Fields of Social Work in Bangladesh)

সমাজকর্ম পেশা


অন্যান্য উন্নত দেশের ন্যায় এদেশের পরিধিগত বিস্তৃতি ঘটেনি। নিয়ে বাংলাদেশে সমাজকর্ম ক্ষেত্রে চালু কর্মসূচি এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো আলোচনা করা হলো: 


১. সামাজিক নীতি ও পরিকল্পনা (Social Policy and Planning)

সামাজিক বহুমুখী সমস্যার সমাধান ও সার্বিক সামাজিক উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু সামাজিক নীতি ও পরিকল্পনা অপরিহার্য। 

সমাজকর্মের প্রক্রিয়া ও কৌশল বিশেষজ্ঞ সমাজকর্মীগণ সামাজিক প্রক্রিয়া ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কেও বিশেষভাবে অভিজ্ঞ। 

তাই সমাজকর্মের অন্যতম প্রাথমিক শর্ত হিসেবে বিবেচিত সামাজিক নীতি ও পরিকল্পনা ক্ষেত্রে এদেশের সমাজকর্মীগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। 

সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সমাজকল্যাণ সংস্থার নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নেও সমাজকর্মীগণ নিয়োজিত রয়েছেন। 


২. পল্লি উন্নয়ন (Rural Development)

বাংলাদেশ পল্লি প্রধান একটি দরিদ্র দেশ। তাই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পল্লি এলাকা অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। 

এদেশে সমাজকল্যাণ কর্মসূচির অগ্রযাত্রাও শুরু হয়েছিল V-AID কর্মসূচির মাধ্যমে। বর্তমানে পরিচালিত সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা পল্লি উন্নয়নে কাজ করে চলেছে। 

নিঃসন্দেহে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সমাজকর্মের অন্যতম কর্মক্ষেত্র। গ্রামীণ নারী, যুবক, বেকার ও ভূমিহীন কৃষকদের সঠিক উদ্বুদ্ধকরণ এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে সামাজিক রীতিনীতি ও মানবীয় আচরণ জ্ঞানসম্পন্ন সমাজকর্ম ব্যবস্থা কার্যকরী ভূমিকা পালনে সক্ষম। 


৩. শহর সমাজসেবা (City social service)

শিল্পায়ন ও নগরায়ণ প্রক্রিয়াজনিত কারণে শহরের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিদেশি অপসংস্কৃতির প্রভাবে শহর সমাজে বিশেষ করে অনুন্নত ও বস্তি এলাকায় দরিদ্রতা, অপরাধ প্রবণতা, স্বাস্থ্যহীনতা, পুষ্টিহীনতা, নোংরা পরিবেশ নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। 

এ ধরনের দুর্দশাগ্রস্ত জনসাধারণের সার্বিক উন্নয়ন শহর সবামূলক কর্মসূচি সমাজকর্মের অন্যতম বিশেষ কর্মক্ষেত্র। 

এদেশের সমাজকর্মীগণ পৌর সমাজসেবা প্রকল্পের আওতায় বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও সচেতনতা, স্বাস্থ্য বিষয়ক কার্যক্রম, জনসংখ্যা কার্যক্রম, পরিবার কল্যাণ, চিত্তবিনোদন কার্যক্রম প্রভৃতি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম। 


৪. সামাজিক আইন প্রণয়ন ক্ষেত্র (Field of Social Legislation)

যে সমাজে সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথা বিদ্যমান এবং অবহেলিত ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই সেই সমাজে সমাজ উন্নয়ন আশা করা যায় না। 

তাই নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক কুপ্রথা দূরীকরণে সামাজিক আইন অপরিহার্য। 

সামাজিক কার্যক্রম নামক সহায়ক পদ্ধতির দ্বারা সমাজকর্মীগণ সামাজিক আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনে সক্ষম। 


৫. পরিবারিক সেবা (Family service)

সমাজের ক্ষুদ্র ও অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে পারিবারিক সেবার ক্ষেত্রে আধুনিক সমাজকর্ম যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। 

বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো প্রত্যক্ষ কর্মক্ষেত্র এখনও সৃষ্টি হয়নি। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর এবং বেসরকরি উদ্যোগে পারিবারিক সেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে অভিজ্ঞ ও দক্ষ সমাজকর্মী নিয়োগ করলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিশুসেবা, দাম্পত্য কলহ নিরসন, পারিবারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতনতা পারিবারিক বিশৃঙ্খলা দূরীকরণ এক কথায় পরিবার কল্যাণে দায়িত্ব পালন করতে পারে। 


৬. স্বাস্থসেবা (Health Care)

সমাজকর্ম বলতে শুধু ব্যক্তি বিশেষের বিশেষ সমস্যা কিংবা কোনো বিশেষ সমষ্টির বিশেষ উন্নয়নকে বোঝায় না। 

সামগ্রিকভাবে দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক ও অন্যান্য সমস্যাও সমাজকর্মের পরিধির আওতাভুক্ত। 

উন্নত দেশসমূহে স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির আওতায় জনগণকে স্বাস্থ্য সচেতনতা, শরীরযন্ত্রের কার্যপ্রক্রিয়া, পুষ্টিজ্ঞান, রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধ শিক্ষা প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান দান করা হয়ে থাকে। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা সমাজকর্মীগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। 

স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে বেসরকারি ও সরকারি উদ্যোগে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কর্মসূচি গ্রহণ করে সমাজকর্ম ক্ষেত্র প্রসারিত করা যায়। 


৭. মানসিক স্বাস্থ্য (Mental health)

জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ফলশ্রুতিতে মানসিক স্বাস্থ্যকে এখন বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। মানসিক রোগ সম্পর্কে পূর্বের ধারণাও পরিবর্তিত হয়েছে। 

DSM-IV প্রায় দুইশত ধরনের মানসিক রোগ চিহ্নিত করেছে। এ ধরনের রোগের চিকিৎসায় মনোচিকিৎসক এবং মনোবিজ্ঞানীদের পাশাপাশি মনোচিকিৎসা সমাজকর্মীগণও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। 

তবে আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ মনোচিকিৎসা সমাজকর্মীর উদ্ভব ঘটেনি। বিশেষজ্ঞ তৈরির ব্যবস্থার মাধ্যমে মানসিক রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে সমাজকর্মের অন্যতম ক্ষেত্রে পরিণত করা যায়। 


৮. প্রতিবন্ধী কল্যাণ (Disability welfare)

অন্ধ, মূক-বধির এবং অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক সক বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পরিচালিত হয়ে থাকে। 

যার মধ্যে অন্ধ স্কুল, মূক-বধির স্কুল এবং শারীরিক বিকলাঙ্গ প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র অন্যতম। বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাতেও এ ধরনের কিছু কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। 

যা নিঃসন্দেহে আধুনিক সমাজকর্মের অন্যতম কর্মক্ষেত্র। এ ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠানে সমাজকর্মীগণ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। 

এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণ করা উচিত এবং যোগ্য ও দক্ষ সমাজকর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা করা উচিত। 


৯. অপরাধ সংশোধন (Crime correction)

বয়স্ক অপরাধ ও কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের মাধ্যমে অপরাধমুক্ত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ ধরনের কর্মসূচি পরিচালিত হয়। 

বাংলাদেশে সংশোধনমূলক কর্মসূচির ব্যাপক প্রসার ঘটে নি। তবে গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত অপরাধ সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে কিশোর অপরাধ সংশোধনে সমাজকর্মীগণ তাদের পেশাদার জ্ঞানের প্রয়োগ করছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বাড়ানো উচিত। 


১০. সামাজিক গবেষণা (Social Research)

সামাজিক সমস্যার প্রকৃতি ও কারণ নির্ণয় এবং সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও মানবীয় এ আচরণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য সংগ্রহ ও ধারণা অর্জনে সামাজিক গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

সমাজকর্ম ব্যবস্থার ফলপ্রসূতায় বর্তমানে সমাজকর্ম গবেষণার ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। যা সামাজিক প্রক্রিয়া ও সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে এবং সমাজকর্ম ব্যবস্থার কৌশলগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সুতরাং বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণা সমাজকর্মের একটি বিশেষ ক্ষেত্র। 


১১. সামাজিক প্রশাসন (Social Administration)

সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানসমূহের সার্বিক পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রক্রিয়ায় সমাজকর্ম প্রশাসন কাজ করে থাকে। 

উন্নত দেশসমূহে সমাজকর্ম প্রশাসন বিশেষজ্ঞগণ সরকারি ও বেসরকারি কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োজিত হয়ে থাকেন। 

আমাদের দেশেও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রশাসনে অভিজ্ঞ প্রশাসন বিশেষজ্ঞগণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url