পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় রাবার ও প্লাস্টিক (How plastics and Rubber affect the environment?)

পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় রাবার ও প্লাস্টিকের ভূমিকা: রাবার ও প্লাস্টিক দুটিই আধুনিক জীবনে অপরিহার্য উপাদান। তবে, অতিরিক্ত ব্যবহার এবং অপরিমিত বর্জ্য পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের জন্য বড় হুমকি।


পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় রাবার ও প্লাস্টিকের প্রভাব

plastics and Rubber affect the environment

How do plastics and Rubber affect the environment?

১) জলাবদ্ধতা:

  • প্লাস্টিকের বর্জ্য নর্দমা, খাল, নদীতে জমা হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।
  • জলাভূমি ভরাট করে প্লাস্টিক জীববৈচিত্র্য হ্রাস করে।

২) মাটির উর্বরতা হ্রাস:

  • প্লাস্টিক মাটিতে মিশে মাটির উর্বরতা নষ্ট করে।
  • রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মাটি ও পানিতে দূষণ তৈরি করে।

৩) জীববৈচিত্র্য হ্রাস:

  • জলাশয়ে প্লাস্টিক জমা হয়ে জলজ প্রাণীর মৃত্যু ঘটায়।
  • প্লাস্টিকের টুকরো খাদ্য হিসেবে ভুল করে গ্রহণ করে প্রাণী মারা যায়।

৪) জলবায়ু পরিবর্তন:

  • রাবার ও প্লাস্টিক উৎপাদন প্রক্রিয়া গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে।
  • প্লাস্টিক পোড়ানো বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ।

৫) স্বাস্থ্য ঝুঁকি:

  • প্লাস্টিক থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
  • মাটি ও পানিতে দূষণ খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।


রাবার কি?

তোমরা পেনসিলের লেখা মোছার জন্য যে ইরেজার ব্যবহার কর, সেটি কী ধরনের বস্তু জান? এটি হলো রাবার। সাইকেল, রিক্সা বা অন্যান্য গাড়ির টায়ার, টিউব, জন্মদিনে ব্যবহৃত বেলুন- এসবই রাবারের তৈরি।

পানির পাইপ, সার্জিক্যাল মোজা, কনভেয়ার বেল্ট, রাবার ব্যান্ড, বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানোর নিপল- এগুলোই রাবারের তৈরি সামগ্রী। 

তাহলে দেখতেই পাচ্ছ, রাবার এবং রাবারজাত পণ্যসামগ্রী আমাদের জীবনের অনেক কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এবার তাহলে রাবার সম্পর্কে আরো একটু বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।


রাবারের ভৌত ধর্ম

প্রাকৃতিক রাবার পানিতে অদ্রবণীয় একটি অদানাদার কঠিন পদার্থ। রাবার কিছু কিছু জৈব দ্রাবক, যেমন: এসিটোন, মিথানল- এগুলোতে অদ্রবণীয় হলেও টারপেন্টাইন, পেট্রোল, ইথার, বেনজিন এগুলোতে সহজেই দ্রবণীয়। 

রাবার সাধারণত সাদা বা হালকা বাদামি রঙের হয়। রাবার একটি স্থিতিস্থাপক পদার্থ অর্থাৎ একে টানলে লম্বা হয় এবং ছেড়ে দিলে আগের অবস্থায় ফিরে যায়। বেশিরভাগ রাবারই তাপ সংবেদনশীল অর্থাৎ তাপ দিলে গলে যায়। 

বিশুদ্ধ রাবার বিদ্যুৎ ও তাপ কুপরিবাহী। তবে আজকাল বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে তৈরি বিদ্যুৎ পরিবাহী রাবার বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন।


রাবারের রাসায়নিক ধর্ম

তোমরা জান, প্রায় প্রতিটি পদার্থ তাপ দিলে আয়তনে বাড়ে। কিন্তু রাবারের বেলায় ঠিক উল্টোটি ঘটে অর্থাৎ তাপ দিলে রাবারের আয়তন কমে যায়।

রাবারের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক ধর্ম হলো এটি বেশ কিছু রাসায়নিক পদার্থ, যেমন- দুর্বল ক্ষার, এসিড, পানি এগুলোর সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে না। যে কারণে কোনো কিছু রক্ষা করার জন্য প্রলেপ দেওয়ার কাজে এটি ব্যবহৃত হয়।

তোমরা কি খেয়াল করে দেখেছ, রাবার দীর্ঘদিন রেখে দিলে কী ঘটে? সেটি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। 

এর কারণ হলো, রাবার বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে। অক্সিজেন ছাড়াও আরো কিছু রাসায়নিক পদার্থ, বিশেষ করে Ozone (O3) প্রাকৃতিক রাবারের সাথে বিক্রিয়া করে, যার কারণে রাবার ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়।


প্লাস্টিক কি?

প্লাস্টিক শব্দের অর্থ হলো সহজে ছাঁচযোগ্য। নরম অবস্থায় প্লাস্টিক ইচ্ছামতো ছাঁচে ফেলে সেটা থেকে নির্দিষ্ট আকার-আকৃতি বিশিষ্ট পদার্থ তৈরি করা যায়। 

আমরা বাসাবাড়িতে নানা রকম প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার করছি। মগ, বালতি, জগ, মেলামাইনের থালা-বাসন, পিভিসি পাইপ, বাচ্চাদের খেলনা, গাড়ির সিটবেল্ট, এমনকি আসাবাবপত্র সবকিছুই প্লাস্টিকের তৈরি। 

তোমরা জান যে এগুলো সবই পলিমার পদার্থ। এবারে প্লাস্টিকের ধর্ম সম্পর্কে একটুখানি জেনে নেওয়া যাক।


প্লাস্টিকের ভৌত ধর্ম

প্লাস্টিক কি পানিতে দ্রবীভূত হয়? না, হয় না। বেশির ভাগ প্লাস্টিকই পানিতে অদ্রবণীয়। প্লাস্টিকের  একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম হলো এরা বিদ্যুৎ ও তাপ পরিবহন করে না। তাই বিদ্যুৎ এবং তাপ নিরোধক হিসেবে এদের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

প্লাস্টিকের সবচেয়ে বড় ধর্ম হলো গলিত অবস্থায় এদেরকে যেকোনো আকার দেওয়া যায়। এই সুবিধার কারণেই এটি নানাবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়। 

তাপ দিলে প্লাস্টিকে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে? পলিথিন, পিভিসি পাইপ, পলিস্টার কাপড়, বাচ্চাদের খেলনা- এসব প্লাস্টিক তাপ দিলে নরম হয়ে যায় এবং গলিত প্লাস্টিক ঠাণ্ডা করলে শক্ত হয়ে যায়। 

এভাবে যতবারই এদেরকে তাপ দেওয়া যায়, এরা নরম হয় ও ঠাণ্ডা করলে শক্ত হয়। এগুলোকে থার্মোপ্লাস্টিকস (Thermoplastics) বলে। 

অন্যদিকে মেলামাইন, বাকেলাইট (যা ফ্রাইং প্যানের হাতলে এবং বৈদ্যুতিক সকেটে ব্যবহার করা হয়) এগুলো তাপ দিলে নরম হয় না বরং পুড়ে শক্ত হয়ে যায়। 

এদেরকে একবারের বেশি ছাঁচে ফেলে নির্দিষ্ট আকার দেওয়া যায় না। এই সকল প্লাস্টিককে থার্মোসেটিং প্লাস্টিকস (Thermosetting Plastics) বলে।


প্লাস্টিকের রাসায়নিক ধর্ম

বেশির ভাগ প্লাস্টিক রাসায়নিকভাবে যথেষ্ট নিষ্ক্রিয়। তাই বাতাসের জলীয় বাষ্প ও অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে না এবং ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। 

এমনকি পাতলা এসিড বা ক্ষারের সাথেও প্লাস্টিক বিক্রিয়া করে না। তবে শক্তিশালী ও ঘনমাত্রার এসিডে কিছু কিছু প্লাস্টিক দ্রবীভূত হয়ে যায়। 

প্লাস্টিক সাধারণত দাহ্য হয় অর্থাৎ এদেরকে আগুন ধরালে পুড়তে থাকে এবং প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন করে।


প্লাস্টিক কি পচনশীল?

না, প্লাস্টিক পচনশীল নয়। দীর্ঘদিন মাটি বা পানিতে পড়ে থাকলেও এসব পচে না। অবশ্য বর্তমানে বিজ্ঞানীরা পচনশীল প্লাস্টিক আবিষ্কার করেছেন, সেগুলো বিশেষ কাজে ব্যবহৃত হয়। 

হাত-পা কেটে গেলে বা মেডিক্যাল অপারেশনে সেলাইয়ের কাজে যে সুতা ব্যবহৃত হয়। সেগুলো এক ধরনের পচনশীল প্লাস্টিক।

প্লাস্টিক পোড়ালে অনেক ক্ষতিকর পদার্থ তৈরি হয়। যেমন: পিভিসি পোড়ালে হাইড্রোজেন ক্লোরাইড (HCl) নিঃসৃত হয়। 

আবার পলিইউরেথেন (Polyurethane) প্লাস্টিক (যা আসবাবপত্র, যেমন: চেয়ার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়) পোড়ালে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস এবং হাইড্রোজেন সায়ানাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়।


পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় রাবার ও প্লাস্টিক

তোমরা জেনেছ যে বেশির ভাগ প্লাস্টিক এবং কৃত্রিম রাবার পচনশীল নয়। এর ফলে পুনর্ব্যবহার না করে বর্জ্য হিসেবে ফেলে দিলে এগুলো পরিবেশে জমা হতে থাকে এবং নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। 

তোমরা কি খেয়াল করে দেখেছ ঢাকা বা অন্যান্য শহরের বেশির ভাগ নর্দমার নালায় প্রচুর প্লাস্টিক বা রাবার জাতীয় জিনিস পড়ে থাকে? এগুলো জমতে জমতে একপর্যায়ে নালা নর্দমা বন্ধ হয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। 

ফলে দেখা যায়, সামান্য বৃষ্টিপাত হলেই রাস্তায় পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, যা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে। 

একইভাবে প্লাস্টিক এবং বর্জ্য পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবস্থাপনা না করায় এর বড় একটি অংশ নদ-নদী, হৃদ বা জলাশয়ে গিয়ে পড়ে। এভাবে জমতে থাকলে একসময় নদীর গভীরতা কমে যায়, যা নাব্যতার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। 

আবার ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বা রাবারের বর্জ্য অনেক সময় মাটিতে থাকলে তা মাটির উর্বরতা নষ্ট করতে পারে। 

ফেলে দেওয়া এসব বর্জ্য অনেক সময় গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি পশুর খাবারের সাথে মিশে তাদের পাকস্থলীতে যায় এবং এক পর্যায়ে সেগুলো মাংস ও চর্বিতে জমতে থাকে। 

এমনকি নদ-নদী, খাল-বিলে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক/রাবার বর্জ্য খাবার গ্রহণের সময় মাছের দেহেও প্রবেশ করতে পারে এবং সেখানে জমা হতে থাকে। 

আমরা সেই মাছ, মাংস খেলে শেষ পর্যন্ত সেগুলো আমাদের দেহে প্রবেশ করে, যা ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করতে পারে। 

তাহলে এটি স্পষ্ট যে প্লাস্টিক ও রাবার সামগ্রী সঠিক ব্যবস্থাপনা না করলে তা মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। 

তাই প্লাস্টিক আর রাবার সামগ্রী যতবার সম্ভব নিজেরা পুনরায় ব্যবহার করতে হবে এবং অন্যদেরও ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। 

ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়লে যেখানে-সেখানে ফেলে না দিয়ে একসাথে জড়ো করে রাখতে হবে। এভাবে জড়ো করা সামগ্রী বিক্রিও করা যায়। 

এতে একদিকে যেমন পরিবেশ সংরক্ষিত হবে, অন্যদিকে তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হওয়া যায়। বিক্রি করার সুযোগ না থাকলে- এটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।


মাইক্রোপ্লাস্টিক: ভয়ঙ্কর পরিবেশ দূষক

মাইক্রোপ্লাস্টিক (Microplastics) হলো ৫ মিলিমিটারের কম আকারের প্লাস্টিকের কণা। এগুলো দুটি প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়:

১) প্রাথমিক মাইক্রোপ্লাস্টিক

  • মাইক্রোবীডস সাবান, ফেসওয়াশ, টুথপেস্ট, এবং অন্যান্য প্রসাধনীতে ব্যবহৃত হয়।
  • প্লাস্টিকের ছোট ছোট টুকরো কৃত্রিম তৃণ, প্লাস্টিকের ব্যাগ, এবং পোশাক থেকে ছেঁড়া অংশ থেকে তৈরি হয়।

২) দ্বিতীয়ক মাইক্রোপ্লাস্টিক

  • বড় প্লাস্টিকের টুকরো পরিবেশে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়।


মাইক্রোপ্লাস্টিকের ভয়াবহতা

পরিবেশ দূষণ

  • জলাশয়, মাটি, এবং বায়ুতে মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশ দূষণ করে।
  • জীববৈচিত্র্য হ্রাস: জলজ প্রাণী মাইক্রোপ্লাস্টিক খেয়ে মারা যায়।

মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব

  • খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
  • শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমেও মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
  • বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

সমাধান

  • প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো
  • প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার
  • মাইক্রোবীডস ব্যবহার না করা
  • পরিবেশ দূষণ রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি

মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশের জন্য একটি ভয়ঙ্কর হুমকি। আমাদের সকলের সচেতন হতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url